মহিষের নিকষকঠিন পাথর-কোঁদা দেহটা ককিয়ে ককিয়ে ওঠে যন্ত্রণায়,
গলা দিয়ে উঠতে থাকে ঘড়-ঘড় কাতর গোঙানি,
মুখে উপচে উপচে বেরোয় চাপ চাপ রক্ত।
বিকট আর্তনাদে
থর থর করে কাঁপে তার একদা অহঙ্কারী মুখ,
কাতরে উঠে দয়া চায়,
ভিক্ষা চায় দেবীর পায়ের পাতা আঙুলে আঁকড়ে ধরে,
পদপেষণে চূর্ণ বক্ষে
দেবে বসে দুর্গার পায়ের চাপ।
যোদ্ধার বলপুষ্ট শরীর
অবহেলায় দলতে দলতে তার রক্তবমন শোনে দুর্গা,
যে কণ্ঠ বিকট গর্জনে
চীৎকার করে গর্ব প্রকাশ করত,
যে কণ্ঠ হুঙ্কার ছাড়ত
চাপ চাপ পেশী-ঠাসা বুক সদম্ভে ফুলিয়ে,
ভয়ঙ্করদর্শন বাহুর পেশী আস্ফালিত করে
ছাড়ত দানবিক অট্টহাসি,
সেই কণ্ঠে পাকিয়ে উঠছে ভাঙা গোঙানি,
ভয়ালতম মল্লযোদ্ধা ঘাড় মুচড়ে পড়েছে এই আশ্চর্য নর্তকীর পদতলে,
যার রূপে দেবদানব স্তবগান ভুলে শ্বাসরুদ্ধ স্তব্ধ,
যার কুহকে কামজিৎ মহেশ্বর কামজর্জর নতজানু,
যার নৃত্যের হিল্লোলে উন্মত্ত হয়েছে সারা অসুরকুল আর
যার শরীরের চুম্বক মহিষাসুরকে টেনে বার করেছে প্রাসাদের বাইরে,
সেই স্বপ্নাপ্সরীর পদতলে অসুররাজের পরাস্ত, পর্যুদস্ত দেহ
যন্ত্রণায় দাপাতে দাপাতে
দয়া ভিক্ষা করে চলেছে।
স্বর্গলিপ্সু দেবতারা স্বর্গ বিস্মৃত হয়ে রুদ্ধবাক দেখছে –
মহিষাসুরের দৈত্যের মতো শরীর কাতরাতে কাতরাতে, গর্জাতে গর্জাতে গোঙাচ্ছে দুর্গার নুপূর-পরা পায়ের তলায়,
দুর্গা থই থই করে হাসতে হাসতে নাচছে, অসুরের বুকে পা দিয়ে।
দেবতারা দেখছে – মহিষাসুরের দেহটা কী ভীষণ, কী প্রচণ্ড শক্তি-ঠাসা
ওই অতিকায় পেশল বজ্র-ভাঙা বুক, যার সংঘর্ষে খান খান হয়ে
ভেঙে পড়েছিল শিবের ত্রিশূল, বিষ্ণুর কৌমদকী –
সেই দানব-বক্ষ খিলখিল করে হাসতে হাসতে নির্মথিত করছে দুর্গা,
নাচের ছলে পায়ে চেপে নামিয়ে দিচ্ছে বুকের ছাতি,
অসুরের পাগলপ্রায় দয়াভিক্ষা অগ্রাহ্য করে।
মহিষাসুরের হাতদুটো প্রবল প্রয়াসে জড়িয়ে ধরেছে দুর্গার দুই জঙ্ঘা,
তার ভীম-বাহু ময়ালকুন্ডলীর মত ফুলে উঠেছে পাকিয়ে ওঠা আস্ফোটে,
দাঁতে দাঁত চেপে সর্বশক্তি দিয়ে,
তার মহিষ-কঠিন পেশীর সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে সে ঠেলছে,
ঠেলে সরাতে চাইছে দেবীর পায়ের মরণ-চাপ…
পারছে না – পারছে না।
দুর্গা হাসতে হাসতে তার শরীরটা চেপে নিচ্ছে নিজের দুই পায়ের মাঝে,
চেপে নিয়ে ফুলিয়ে তুলছে তার নৃত্য-বিভোল অঙ্গসৌষ্ঠব
নর্তকীর লালিত্যের তলায় শক্তির গোপন ইঙ্গিত উঠছে
ইস্পাতমসৃণ শক্তিমাখা পেশীর মুচকি আভাসে।
দেবীর সুডৌল দুই জঙ্ঘা চেপে বসছে দানবের দেহে,
মহিষাসুরের লোহা-বুক নিংড়ে গোঙানি উঠে আসছে মুখে,
দয়া চাইবার জন্য কাতরাতে কাতরাতে মুখ খুলছে,
পারছে না, উল্ক দিয়ে উগরে আসছে রক্ত।
দেখছে দেবতারা – ওই পেশী-ঠাসা চেতানো বুকের ছাতি ভাঙছে…
মহিষের দেহ ভাঙছে রূপসী নর্তকীর পায়ে।
অসুররা দেখছে সভয়ে,
দুর্গা বাম পা বাড়িয়ে দিচ্ছে মহিষাসুরের
মুখের সামনে,
বাড়িয়ে জঙ্ঘা স্ফীত করে মুখের সামনে ধরছে ব্যঙ্গভরে,
মহিষাসুর ভয়ে গোঙাতে গোঙাতে দয়া চাইছে।
যে পায়ের নিক্কণে মাতাল হয়ে ছুটে এসেছিল
মাত্র কিছুক্ষণ আগে,
যে সুগোল জঙ্ঘার সুঠাম উদ্ভাস জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল
দুই মুশল বাহুর ডোরে,
যে চপল তনুর হিল্লোলে উন্মাদ হয়ে দূতের পরে দূত পাঠিয়েছিল
কটাক্ষবিহ্বল অসুররাজ – “ওই কামরূপিনী নারীকে আমার চাই!”
সেই ঘুঙুর-বাজা পদপ্রান্তেই লুটিয়ে গড়াচ্ছে এখন,
রুম্-ঝুম্ শব্দে বার বার সে পদতল আছড়ে পড়ছে তার বুকে।
এখন সেই জঙ্ঘাই দুই হাতে আঁকড়ে ধরেছে প্রাণভয়ে,
করুণা ভিক্ষা করছে দুর্গার পীড়নে…. যন্ত্রণাকাতর শব্দে।
ছম্-ছম্ নুপূর বাজিয়ে হা-হা হাসছে দানবদলনী, আর অসুর
দেবীর একেকবারের চাপে
মুহূর্মুহূ ককিয়ে ককিয়ে উঠছে মুখ থেকে রক্ত ফেলতে ফেলতে।
দশপ্রহরণ নয়, নয় ধার-পাওয়া ত্রিশূল খড়্গ
দেবী পিষছে তাকে পদতলে
নেচে নেচে চেতানো বুকটায় পদাঘাত করছে:
“থৈ…. থৈ….. থৈ – – –
“-হি-য়া্-ক্- ! – আ-হ্-ক্=-!!”
অসুরের দৈত্যের মতো শরীর ঝাঁকুনি খেয়ে কাতরে উঠছে!
দুর্গা বাঁকা হেসে পা দিয়ে দলছেন –
” – থই .. থই … থই – -“
“ন্ন্না-র্-র্-গ-গ-হহ!!!” — বিকট গোঙিয়ে উঠছে অসুর
দেবী পা একধারে বাঁকিয়ে ধরে অসুরের বুকে তাল দিচ্ছেন –
“তা- ! তা- ! – থেই… থেই… –
থেই – থেই – থিয়া থেই
ধিতিকা ধিতিকা থেই…
আর পর্বতাকার মহিষাকৃতি দেহটা পদাঘাতে পদাঘাতে কাতরে ছটকাচ্ছে
যে স্বপ্ন ছিল ত্রিভুবনে অক্ষয় রাজত্বের
যে স্বপ্ন ছিল অপরাজিত যোদ্ধা হওয়ার খ্যাতির
যে স্বপ্ন, লোভ ছিল প্রচণ্ডতম পুরুষ হয়ে অমরত্বের,
যার বাহুবলে মৃত্যু স্বয়ং সভয়ে পিছু হটে যায়,
যার অটল শক্তি সিংহানে আসীন থাকার কথা ছিল অনন্তকাল…
এই নৃত্যাঙ্গনার পায়ে লেগে সেই পাশা উলটে গেছে
এখন ত্রিভুবন দেখছে,
মহিষাসুরের ব্যথায় বেঁকে যাওয়া মুখ
মুখ দিয়ে বুদ্বুদের মতো ফেনিয়ে উঠছে কালচে রক্ত
ভলক দিয়ে দিয়ে রক্ত বমি উঠছে “-আ-আগ্লহ্ক….আ-ঘ্ল্কক্…” করে, মুখে যন্ত্রণা,
গোঙাচ্ছে দুর্গার পায়ে চাপা হয়ে
দয়া ভিক্ষা করছে নর্তকীর কাছে
“না….না…না….না…….”